অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হলো একটি অস্থায়ী সরকার, যা একটি দেশের নিয়মিত নির্বাচনের আগে বা পরে প্রশাসনের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য গঠিত হয়। এটি সাধারণত এমন সময়ে কার্যকর হয় যখন একটি দেশ রাজনৈতিক পরিবর্তন বা সংকটের মধ্য দিয়ে যায় এবং নতুন নির্বাচিত সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পূর্ব পর্যন্ত প্রশাসন পরিচালনার প্রয়োজন হয়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সরাসরি কোনো রাজনৈতিক পক্ষের প্রতি অনুগত না থেকে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করে, যাতে আসন্ন নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন হতে পারে। এর প্রধান কাজ হলো একটি নতুন নির্বাচনের আয়োজন করা এবং সেই নির্বাচনের মাধ্যমে একটি বৈধ সরকার প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করা।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উদ্দেশ্য
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মূল উদ্দেশ্য হলো রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখা। বিশেষ করে ক্ষমতার হস্তান্তরের সময় যখন রাজনৈতিক উত্তেজনা বা অস্থিতিশীলতা তৈরি হতে পারে, তখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য দায়িত্ব গ্রহণ করে। এর প্রধান উদ্দেশ্যগুলো হলো:
- নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন: অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব হলো নির্বাচন কমিশনের সাথে সমন্বয় করে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। এটি নির্বাচনকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে সাহায্য করে, যাতে জনগণ স্বাধীনভাবে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে।
- স্থায়ী সরকারের অভাব পূরণ করা: কোনো কারণবশত যদি স্থায়ী সরকার পদত্যাগ করে বা ক্ষমতাচ্যুত হয়, তবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অস্থায়ীভাবে প্রশাসন পরিচালনা করে এবং সরকারি কাজগুলো অচল না হয়ে যায় তা নিশ্চিত করে।
- রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা: অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতা হস্তান্তরের সময় দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে ভূমিকা পালন করে। এটি কোনো পক্ষপাতিত্ব বা রাজনৈতিক উত্তেজনা ছাড়াই প্রশাসনিক কাজ সম্পন্ন করার চেষ্টা করে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাজ
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কার্যাবলী মূলত সীমাবদ্ধ থাকে, কারণ এটি শুধুমাত্র একটি অস্থায়ী ব্যবস্থা। তবে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ রয়েছে যা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সম্পাদন করে:
- প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনা: একটি স্থায়ী সরকার না থাকলেও দেশের প্রশাসনিক কার্যক্রম অব্যাহত রাখা অত্যন্ত জরুরি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রশাসনের দৈনন্দিন কাজ পরিচালনা করে এবং সেবা প্রদান অব্যাহত রাখে।
- নির্বাচন কমিশনের সাথে সমন্বয়: একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নির্বাচন কমিশনের সাথে নিবিড়ভাবে কাজ করে। এটি নির্বাচনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করা এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করে।
- সংবিধান অনুসরণ করা: অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সংবিধান অনুযায়ী কাজ করে এবং প্রশাসনিক ক্ষমতার অপব্যবহার না করার প্রতিশ্রুতি দেয়। এটি নিশ্চিত করে যে নির্বাচনের সময় কোনো রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠী বিশেষ সুবিধা না পায়।
- জনগণের সুরক্ষা নিশ্চিত করা: নির্বাচন পূর্ববর্তী ও নির্বাচন পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে জনগণের সুরক্ষা এবং দেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে।
উদাহরণ ও প্রভাব
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উদাহরণ বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে পাওয়া যায়। যেমন, বাংলাদেশে ১৯৯৬ এবং ২০০৮ সালে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এই সরকারগুলোর মূল লক্ষ্য ছিল একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করা। এমন ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে দেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সচল থাকে এবং রাজনৈতিক সংকট কাটিয়ে ওঠা যায়।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গুরুত্ব
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি ক্ষমতার শান্তিপূর্ণ ও সাংবিধানিক হস্তান্তর নিশ্চিত করে, যা একটি দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল এবং বিরোধী দল উভয়ের জন্যই এটি একটি সুরক্ষা দেয় যে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হবে এবং জনগণের মতামত স্বাধীনভাবে প্রতিফলিত হবে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার: উপসংহার
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একটি দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি ক্ষমতার ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করে এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা থেকে দেশকে রক্ষা করতে সাহায্য করে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মূল লক্ষ্য হলো নিরপেক্ষভাবে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজন করা এবং প্রশাসনিক কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা বজায় রাখা।
এর মাধ্যমে জনগণ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ পায় এবং একটি বৈধ ও জনপ্রতিনিধিত্বমূলক সরকার গঠনের পথ সুগম হয়। অতএব, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গণতন্ত্রের স্থায়িত্ব ও দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য অপরিহার্য।