ব্যবসায়িক দুনিয়ায় “টার্নওভার” একটি খুবই সাধারণ এবং গুরুত্বপূর্ণ শব্দ। আপনি যদি ব্যবসা করেন বা ব্যবসার প্রতি আগ্রহী হন, তাহলে “টার্নওভার” শব্দটি আপনাকে বিভিন্ন সময়ে শোনা লাগবে। কিন্তু টার্নওভার বলতে আসলে কি বোঝায়? এবং এটি ব্যবসার ক্ষেত্রে কেন গুরুত্বপূর্ণ? আজকের এই আর্টিকেলে আমরা সেই বিষয়গুলো সহজ ভাষায় ব্যাখ্যা করবো এবং কিছু বাস্তব উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টি পরিষ্কার করার চেষ্টা করবো।
টার্নওভার কি? (What is Turnover?)
টার্নওভার শব্দটি মূলত ইংরেজি ভাষা থেকে এসেছে এবং এর মানে হল কোনো নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে একটি ব্যবসা কত টাকার লেনদেন করেছে। এটি সাধারণত বার্ষিক ভিত্তিতে গণনা করা হয়। সহজভাবে বলতে গেলে, একটি কোম্পানি বছরে কত পরিমাণ বিক্রি করেছে বা আয় করেছে, সেটিই তার টার্নওভার।
অনেক সময় এই শব্দটি “রাজস্ব” বা “রেভিনিউ” শব্দটির সাথে গুলিয়ে ফেলা হয়, কিন্তু দুটোর মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। রাজস্ব বলতে বোঝায় সম্পূর্ণ আয়, কিন্তু টার্নওভার শুধু আয়ের পরিমাণ নির্দেশ করে না, বরং এটি একটি নির্দিষ্ট সময়ে সম্পন্ন হওয়া বিক্রয় কার্যক্রমের দিকেও ইঙ্গিত দেয়।
টার্নওভারের ধরন (Types of Turnover)
টার্নওভার বিভিন্ন ধরনের হতে পারে এবং বিভিন্ন ব্যবসা ক্ষেত্রেও এর প্রয়োগ ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। নিচে আমরা কিছু সাধারণ ধরনের টার্নওভার নিয়ে আলোচনা করছি:
১. সেলস টার্নওভার (Sales Turnover)
সেলস টার্নওভার একটি প্রতিষ্ঠানের মোট বিক্রির পরিমাণকে বোঝায়। এটি প্রধানত ব্যবসার আয়, এবং এটি সাধারণত সেলস বা বিক্রির উপর ভিত্তি করে গণনা করা হয়।
উদাহরণ: ধরুন, ABC কোম্পানির বার্ষিক বিক্রির পরিমাণ ১০ লক্ষ টাকা। সেক্ষেত্রে, কোম্পানির সেলস টার্নওভার ১০ লক্ষ টাকা।
২. স্টাফ টার্নওভার (Staff Turnover)
স্টাফ টার্নওভার একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের পরিবর্তন হার নির্দেশ করে। যদি একটি কোম্পানি বার্ষিক ভিত্তিতে অনেক কর্মচারী নিয়োগ করে এবং একই হারে কর্মচারী চলে যায়, সেটাই তার স্টাফ টার্নওভার।
উদাহরণ: একটি আইটি কোম্পানিতে বছরে মোট ৫০ জন কর্মচারী আছে, এর মধ্যে ১০ জন কর্মচারী বছরে প্রতিষ্ঠান ছেড়ে চলে যায়। তাই, এর স্টাফ টার্নওভার হবে ২০%।
৩. ইনভেন্টরি টার্নওভার (Inventory Turnover)
ইনভেন্টরি টার্নওভার একটি কোম্পানি তার ইনভেন্টরি বা মজুত পণ্য কত দ্রুত বিক্রি করতে পারে, তা নির্দেশ করে।
উদাহরণ: একটি পোশাক কোম্পানি বছরে ৫০০০ ইউনিট পোশাক তৈরি করে এবং সবগুলো বিক্রি করে দেয়। সেক্ষেত্রে, তার ইনভেন্টরি টার্নওভার হবে ৫০০০ ইউনিট।
টার্নওভার কেন গুরুত্বপূর্ণ? (Why is Turnover Important?)
টার্নওভার শুধু ব্যবসার আয়ই নির্দেশ করে না, বরং এটি কোম্পানির কর্মক্ষমতা, পণ্যের জনপ্রিয়তা, এবং পরিচালনার দক্ষতারও পরিচয় দেয়। এটি একটি ব্যবসার সামগ্রিক সফলতা নির্ধারণে বড় ভূমিকা পালন করে। নিচে কিছু কারণ উল্লেখ করা হলো:
- আর্থিক অবস্থা বুঝতে সাহায্য করে: টার্নওভার একটি প্রতিষ্ঠানের আর্থিক স্থিতিশীলতা এবং কার্যকারিতা পরিমাপ করতে সাহায্য করে।
- বাজারে প্রতিযোগিতা বোঝাতে সাহায্য করে: টার্নওভার দেখে বোঝা যায়, প্রতিযোগিতামূলক বাজারে একটি কোম্পানি কেমন পারফর্ম করছে।
- উন্নতির সুযোগ নির্ধারণ: টার্নওভার বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, কোম্পানির কোন অংশে উন্নতি দরকার। যদি স্টাফ টার্নওভার বেশি হয়, তবে কোম্পানির জন্য এটি একটি সতর্ক সংকেত।
টার্নওভার নির্ণয়ের প্রক্রিয়া (How to Calculate Turnover)
টার্নওভার নির্ণয়ের পদ্ধতি বেশ সহজ এবং সাধারণত দুটি পদ্ধতির উপর ভিত্তি করে করা হয়:
১. সেলস টার্নওভার গণনা:
সেলস টার্নওভার হিসাব করার ফর্মুলা:
সেলস টার্নওভার = মোট বিক্রয় – ফেরত বিক্রয়
উদাহরণ: যদি একটি কোম্পানির মোট বিক্রয় ২০ লক্ষ টাকা হয় এবং ফেরত বিক্রয় ২ লক্ষ টাকা, তাহলে সেলস টার্নওভার হবে:
২০ লক্ষ – ২ লক্ষ = ১৮ লক্ষ টাকা।
২. ইনভেন্টরি টার্নওভার গণনা:
ইনভেন্টরি টার্নওভার = বিক্রয়ের খরচ / গড় ইনভেন্টরি
উদাহরণ: একটি কোম্পানির বিক্রয়ের খরচ ১০ লক্ষ টাকা এবং গড় ইনভেন্টরি ২ লক্ষ টাকা, তাহলে ইনভেন্টরি টার্নওভার হবে:
১০ লক্ষ / ২ লক্ষ = ৫।
টার্নওভার এবং লাভের মধ্যে পার্থক্য (Turnover vs Profit)
অনেকেই টার্নওভার এবং লাভের মধ্যে পার্থক্য নিয়ে দ্বিধায় পড়েন। টার্নওভার কোম্পানির বিক্রয় বা আয়ের মোট পরিমাণ নির্দেশ করে, যখন লাভ হচ্ছে ব্যয় বাদ দেওয়ার পর অবশিষ্ট থাকা টাকা। তাই, টার্নওভার বেশি হলেও লাভ কম হতে পারে যদি ব্যয় বেশি হয়।
বিষয় | টার্নওভার | লাভ |
---|---|---|
অর্থ | মোট বিক্রয় | আয়ের পর ব্যয় বাদ |
হিসাব | মোট বিক্রয় – ফেরত বিক্রয় | টার্নওভার – ব্যয় |
কিছু প্রাসঙ্গিক তথ্য (Stats on Turnover)
টার্নওভারের বিভিন্ন তথ্য একটি দেশের অর্থনীতির অবস্থা বোঝাতেও সাহায্য করে। একটি গবেষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশে স্টার্টআপ কোম্পানির স্টাফ টার্নওভার হার প্রায় ১৫-২০%। এই হার বিশ্বব্যাপী গড় স্টাফ টার্নওভারের তুলনায় কিছুটা বেশি। বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অফ সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (BASIS) রিপোর্ট অনুযায়ী, দেশের বেশিরভাগ আইটি কোম্পানির টার্নওভার বছরে ৫০-৬০% পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়, যা এই খাতে দ্রুত বর্ধমান চাহিদার প্রতিফলন।
টার্নওভার বৃদ্ধি করার উপায় (Ways to Increase Turnover)
ব্যবসায় সফলতা পেতে টার্নওভার বৃদ্ধি করা জরুরি। নিচে কিছু কার্যকর উপায় উল্লেখ করা হলো:
- বাজার গবেষণা করা: আপনার লক্ষ্যবস্তু গ্রাহকদের পছন্দ সম্পর্কে জানুন এবং তাদের অনুযায়ী পণ্য তৈরি করুন।
- গ্রাহক সম্পর্ক উন্নয়ন: গ্রাহকদের সাথে ভালো সম্পর্ক তৈরি করলে বিক্রয় বাড়াতে সহায়ক হয়।
- পণ্যের মান বজায় রাখা: মানসম্মত পণ্য গ্রাহকদের আকৃষ্ট করে এবং বিক্রয় বৃদ্ধি করে।
- বিপণন ও প্রচারণা বৃদ্ধি: আপনার পণ্য সম্পর্কে আরও বেশি প্রচারণা চালান এবং সঠিক মার্কেটিং পরিকল্পনা গ্রহণ করুন।
টার্নওভার এবং ব্যবসায়িক সিদ্ধান্ত (Turnover and Business Decisions)
টার্নওভার বিশ্লেষণ একটি ব্যবসার ভবিষ্যত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। টার্নওভার বেশি থাকলে কোম্পানির অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো থাকে এবং এটি কোম্পানির পরবর্তী বিনিয়োগ পরিকল্পনা নির্ধারণে সাহায্য করে। আবার, স্টাফ টার্নওভার বেশি থাকলে কোম্পানিকে কর্মী নিয়োগ প্রক্রিয়া এবং কাজের পরিবেশ নিয়ে নতুন করে ভাবতে হয়।
উপসংহার (Conclusion)
টার্নওভার ব্যবসার সফলতা এবং কার্যকারিতা নির্ধারণে একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক। এটি শুধু বিক্রয়ের পরিমাণই নির্দেশ করে না বরং কোম্পানির আর্থিক স্থিতি, পণ্যের জনপ্রিয়তা, কর্মচারীদের স্থায়িত্ব এবং বাজারে প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রেও অবদান রাখে। ব্যবসার প্রতিটি খুঁটিনাটি বিশ্লেষণ করতে হলে টার্নওভারের দিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন। আশা করছি, এই আর্টিকেলের মাধ্যমে টার্নওভার সম্পর্কে একটি পরিষ্কার ধারণা পেয়েছেন, যা আপনাকে আপনার ব্যবসায়িক সিদ্ধান্তে আরও কার্যকরী করতে সহায়তা করবে।